কবি রজনীকান্ত সেনের লেখা ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/ কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/ তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।’ কবিতার লাইনগুলো নিশ্চয়ই আজো সবার মনে আছে। পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকা কবিতাটি পড়ে শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখি ও বাবুই পাখির শিল্পনিপুণতার কথা জানতে পারলেও মানুষের অসচেতনতায় আজ বাবুই পাখি ও এদের বাসার অস্তিত্ব হুমকির মুখে। হারিয়ে যাওয়া কালো বাবুইয়ের দেখা পাওয়া গেল মেহেরপুরের হরিরামপুর বিলপাড়ের কাশবনে।
পক্ষি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখি আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুইয়ের মধ্যে বাংলা ও দাগি বাবুই প্রজাতি বিলুপ্তির পথে, তবে দেশি কালো বাবুই এখনো দেশের সব গ্রামের তাল, নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি গাছে দলবেঁধে বাসা বোনে। এরা সাধারণত মানুষের কাছাকাছি বসবাস করে। ফলে অনেক অসচেতন মানুষের অত্যাচার ও বসবাসের পরিবেশের অভাবে এদের সংখ্যা রহস্যজনকভাবে কমে যাচ্ছে।
মেহেরপুর জেলার পাখি প্রেমিদের সংগঠন ‘কিচির মিচির বার্ড ক্লাবের সভাপতি ফারিহা ইকবাল কালো বাবুই সম্পর্কে বলেন, “এ বাবুই পরিবেশের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। এদের বাসা বুননের সময় বর্ষাকাল। এ সময় দক্ষিণ পশ্চিম থেকে আসা মৌসুমী বাতাস যেন ক্ষতি করতে না পারে এজন্য বাসার মুখগুলো পূর্বমুখি করে বুনে। বাসায় ঢোকা ও বের হওয়া বাদেও বাড়তি একটি পথ তারা তৈরি করে রাখে। যাতে সাপ. গিরগিটি জাতীয় শিকারীরা সেই ছদ্মবেশী পথে পথ ভুল করতে পারে। যাতে তাদের অবস্থানের জায়গাটি না চিনতে পারে। বাবুই নলখাগড়া ও হোগলা দিয়ে বাসা বুনে । কিন্তু দেশে নলখাগড়া ও হোগলার বন কমে যাওয়ায় এ বাবুইয়ের সংখ্যা খুবই কম। যেসব নলখাগড়া ও হোগলার বনে মানুষের চলাচল থাকে এ পাখি সেখানে বাস করে । এরা সাধারণত খুটে খুটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে।”
‘কিচির মিচির বার্ড ক্লাবের’ সদস্য সদানন্দ মন্ডল জানান, এরা খুব সুন্দর বাসা বোনে বলে ‘তাঁতি পাখি’ নামেও পরিচিত। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল হলেও আকৃতি খুব সুন্দর। কয়েক প্রজাতির বাবুই একাধিক কক্ষবিশিষ্ট বাসা তৈরি করতে পারে। বাবুই পাখি সারা বিশ্বে ১১৭ প্রকার। তবে বাংলাদেশে ৩ প্রজাতির বাবুইয়ের মধ্যে কালো বাবুই এখনও দেখা যায়। বাবুই পাখি দেশের সব গ্রামের তাল, নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি গাছে বাসা বুনে বসবাস করে। তবে বুক কালো দাগি বাবুই নদ নদীর পাড়ে কাশবনে বসবাস করে। বেশিরভাগ বাবুই প্রজাতির পুরুষ সদস্য বেশ উজ্জ্বল রঙের হয়।
বাবুই পাখি বাসা তৈরি করার পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিকে সাথী বানানোর জন্য ভাব-ভালোবাসা নিবেদন করে এবং বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হতেই স্ত্রী বাবুইকে বাসা দেখায়। কারণ বাসা পছন্দ হলেই কেবল এদের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুই পাখির সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচদিন।
একসময় দেশের বিভিন্ন জনপদে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তাল, খেজুর ও নারকেল গাছের পাতার সঙ্গে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত। কালের বিবর্তনে এখন তা আর সচরাচর চোখে পড়ে না। বর্তমানে যেমন তালগাছসহ বিভিন্ন গাছ নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও। একশ্রেণির মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। এ বাবুই পাখির বাসা শোভা পাচ্ছে ধনীদের ড্রইং রুমে। বাবুই পাখির এ শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে জানিয়েছেন কিচির মিচির সংগঠনটি।