৩১ বছর আগে রাজধানীর বেইলি রোডে খুন হয়েছিলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক সগিরা মোর্শেদ। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। সেসময় চাঞ্চল্যকর ওই খুনের ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে ডিবি পুলিশ বলেছিল, ছিনতাইকারীর গুলিতে তিনি খুন হন।
ওই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ২৮ বছর আগে নিম্ন আদালতে বিচারও শুরু হয়েছিল; কিন্তু বিচারের মাঝপথে অধিকতর তদন্তের কারণে ১৯৯১ সালে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত করে দেন হাইকোর্ট। সেই স্থগিতাদেশ উঠল ২৮ বছর পর, ২০১৯ সালে। ডিবি পুলিশের পরিবর্তে মামলার অধিকতর তদন্তভার দেয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। তদন্তে প্রায় ৩১ বছর পর খুনের রহস্য উন্মোচন করে পিবিআই।
পাঁচ মাসের তদন্ত শেষে পিবিআই বলেছে, পারিবারিক কলহ থেকেই ওই খুনের ঘটনা ঘটে। খুনের মূল পরিকল্পনা করেন সগিরা মোর্শেদের স্বামী সালাম চৌধুরীর বড়ো ভাই বারডেম হাসপাতালের চিকিত্সক ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪)। ডা. হাসানের শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) ও তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে মারুফ রেজা (৫৯) পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেন।
সেই অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকার চুক্তিতে খুন করতে সম্মত হন মারুফ রেজা। খুনের আগে সগিরা মোর্শেদকে রাজারবাগের বাসার সামনে থেকে চিনিয়ে দেন আনাস মাহমুদ। যিনি বর্তমানে এনজিও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের এক বড় কর্মকর্তা। প্রায় ৩১ বছর পর অধিকতর তদন্তে খুনের সঙ্গে এই চার জনের সম্পৃক্ততা পেয়ে চলতি সপ্তাহে তাদের গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারের পর গত বুধ ও বৃহস্পতিবার চার জনই ঢাকার সিএমএম আদালতে সগিরা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এরপরই তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। ঘুরে যায় পুরো দৃশ্যপট।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, নিহত সগিরা মোর্শেদ ও সায়েদাতুল মাহমুদা সম্পর্কে জাঁ। রাজারবাগে একই বাসায় থাকার কারণে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক দ্বন্দ্বে সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফ রেজাকে ২৫ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয়। আর মারুফ ছিলেন ডা. হাসান আলীর পেশেন্ট (রোগী)। সেখান থেকে তাদের পরিচয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে খুনের দায়িত্ব দেয়া হয় মারুফকে। এই মারুফই রিভলবার দিয়ে দুই রাউন্ড গুলি করে খুন করেন সগিরাকে; কিন্তু খুনের জন্য সেই টাকা আজও মারুফকে দেননি হাসান।
‘তোমাকে আমি চিনি’
জবানবন্দিতে আসামিরা বলেন, ঘটনার দিন মারুফ রেজার মোটরসাইকেলে ছিলেন আনাস মাহমুদ। রিকশাযোগে সগিরা স্কুলে আসার পথে তারা পিছু নেন। বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে কয়েক গজ দূরে তারা মোটরসাইকেল দিয়ে রিকশাটি ব্যারিকেড দেন। সগিরার হাতে থাকা ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করেন মারুফ। তখন আনাসকে দেখে সগিরা বলেন, “এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?”
এই কথা বলার পরই মারুফ ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সগিরার বুকে গুলি করে পালিয়ে যান। মারুফ রেজার বাসা বেইলি রোডে। তিনি বর্তমানে একজন নামকরা আবাসন ব্যবসায়ী।
‘আমি নিশ্চিত ন্যায় বিচার পাব’
সগিরার স্বামী সালাম চৌধুরী বর্তমানে একটি স্কুল পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, “হত্যার পর আমার বড়ো ভাই হাসান আমাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকে। বারবার বলেন, মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। তোমার মেয়েদের বিপদ হতে পারে। মারুফও বেনামি টেলিফোনে হুমকি দেয়।”
তিনি বলেন, “পিবিআই যে কাজটি করেছে তা প্রশংসারযোগ্য। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে স্ত্রী হত্যার বিচার আমি ও আমার সন্তানেরা পাবে।”
প্রসঙ্গত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তার স্বামী সালাম চৌধুরী ছিলেন তার সহপাঠী।
এদিকে মারুফের আবেদনেই ২৮ বছর স্থগিত ছিল বিচারকাজ। এরপর গত জুন মাসে হাইকোর্ট ওই স্থগিতাদেশ তুলে নেন। আদালত বলেন, রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিচার বিভাগও এর দায় এড়াতে পারে না।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জবানবন্দিতে মারুফ রেজার নাম আসে। ১৯৯১ সালে মামলাটি অধিকতর তদন্তে যায়। এ আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেন মারুফ।