যে মারজিয়া কখনো আমার ছিল না
আজ আমার সমুখে তুমি বসে আছো আড়াআড়ি ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিমে যেখানে দেয়ালে ঝুলছিল জাঁ জেনের একটি পোর্ট্রেট। আমি যেন বা অনাহূত অতিথি এক তুমি বরাবর ঘরের পূব-উত্তরে সাফোর একটি পেন্সিল স্কেচ ঝুলছিল যেখানে দেয়ালে। ২৫ বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা। না, কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য নয়। ২৫ বছর আগেও নয়, তোমার সঙ্গে আমার এর আগে কখনোই দেখা হয়নি। এক জীবনে এই প্রথম তোমাকে দেখতে পেলাম। ২৫ বছর আগেও দেখা হতে পারতো কিংবা দেখা হবার কথা ছিল যদি আমাদের ইশকুল ঘরগুলি আলাদা না হয়ে একসঙ্গে হতো। তোমরা ছিলে বালিকা শাখায় প্রধান সড়কের ওপারে আর এপারে বালক শাখা আমাদের। ২৫ বছর আগে তুমি ক্লাস নাইনে আমিও ক্লাস নাইন– ছিলাম তোমার অচেনা এক বৈশিষ্ট্যহীন ক্লাসমেট। আমরা যে ক্লাসমেট সে কথা তখন জানবার উপায় ছিল কোনো! ‘তুমি’ রকমের একটি আশ্চর্য ফুল যে ফুটে ছিল সহস্র ফুলের মাঝখানে সে কথা তখন– বললাম তো জ্ঞানের বাইরে ছিল খুব। সেই ফুল সম্পর্কে কিছুই না জেনে কেটে গেছে ২৫টি বছর। আজ সেই ফুটন্ত ফুল আমার সঙ্গে আড়াআড়ি দূরত্বে বসে আছে অনতিক্রম্য দূরত্বকে গেঁথে নিয়ে। আজ তোমার বর আছে সংসার আছে ঘর জুড়ে আছে ফুটফুটে সোনামণিদের হৃদয় কাঁপানো ভালোলাগা। আর আমার? সে কথা থাক। ফিরে আসি যে প্রসঙ্গে বলছিলাম– চোরা দৃষ্টিতে আমি কখনো অভ্যস্ত ছিলাম না। সম্ভবত লজ্জাবশত কিংবা ভীরু অথবা কাপুরুষ বলে (নাকি চোরা চোখ এক ধরনের কাপুরুষতা!)। শুধু অনভ্যস্ততা নয়, কীভাবে তাকালে চোরা দৃষ্টি বলে সেও আমার কাছে অস্পষ্ট রয়ে গিয়েছিল। অথচ আজ আমি তোমার দৃষ্টি এড়িয়ে তোমার দৃষ্টির দিকে চোখের দিকে কীভাবে যেন– হয়তো নির্লজ্জের মতো একাধিকবার তাকিয়ে তোমাকে দেখে নেবার চেষ্টা করেছিলাম। জুল জুল আর কিছুটা সন্ত্রস্ত তাকিয়ে থাকা আমার দিকে তুমি তাকাওনি একটিবার। আমার দৃষ্টি যখন অন্য কোথাও নিবদ্ধ ছিল তখনও আমি নিশ্চিত তুমি আমার দিকে মুহূর্তকালও তাকিয়ে থাকো নি। থাকবার কথাও নয়। আমি তো আর মালি নই কোনো প্রসিদ্ধ বাগানের যে তাকিয়ে থাকবে তুমি অনিচ্ছে হলেও অবিরাম বাধ্যতামূলক রুটিনের মতো! তুমি জানতেও পারবে না ৪০ ছুঁই ছুঁই করেও তুমি আমার কাছে শুধু আমার কাছেই সদ্য ফুটে থাকা ফুল।
আজ থেকে ২০ বছর আগে বাগান থেকে তোমাকে নির্মমভাবে ছিঁড়ে নিয়ে টবের মধ্যে সাজিয়ে রাখতে চেয়েছিল এবং হয়েছিল অযোগ্যভাবে সফল– সাজিয়ে রাখতে পেরেছিলে সেই মুর্খটা। মূর্খ বলেই জানতো না টবের মধ্যে তুমি ততোটাই বেমানান। তুমি তো ছাই নও খেয়ে ফেলা সিগ্রেটের যে গন্তব্য হবে অ্যাশট্রেতে তোমার– উচ্ছিস্টের মতো। আমি হলে কখনোই তোমাকে ছিঁড়ে নিতাম না নির্মমভাবে ওরকম। বরং কুমারী বাগান আরো সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাকে ভাসিয়ে দিতাম আশ্চর্য থেকে অত্যাশ্চর্য রূপে। তুমি অমরত্ব নিয়ে থেকে যেতে চিরদিন জোছনার মতো যেনো ঈশ্বরের গোপন কোনো সাম্রাজ্য থেকে ছুটে আসা এক অতলান্তিক প্রজাপতি যে শুধু আমার কাছে আসবে বলেই এতদিন আসে নি কোনোদিন।
কিন্তু তোমাকে ছিঁড়ে নেবার ষড়যন্ত্রময় সেই মুহূর্তটি জেনে নেয়া আমার মতন খুব সাধারণ ‘আমি’র কাছে ছিল দ্বিতীয়বার মৃত্যুর মতোন অসম্ভব কোনো জীবন।
মারজিয়া, কী করে জানবো বলো! তুমি যে কখনো আমার ছিলে না। হতে চাওনি কখনো একটি দুর্লভ প্রহরের জন্যে হলেও শুধুই আমার শরবিদ্ধ কোনো কোয়েলের মতন কেবলই আমার।
নকশারবাড়ি কমরেড গদর
গান আর কবিতায় বিপ্লব ছড়িয়ে দেবার অপরাধে
তাকে নিয়ে আসা হলো বদ্ধভূমিতে
সর্বশেষ বুলেট যখন হৃৎপিণ্ড
রক্তাক্ত করছিল তার
তখনও কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসছিল:
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
শহিদদের লাল সেলাম
আমি এখনও কমিউনিস্ট
আমার বন্ধু সুরঞ্জন
শেষবার যখন দেখা হলো সুরঞ্জন বোলেছিলো: চতুর্দিকে শুধু ভাঙনের শব্দ যে-দিকে তাকাই দেখি মানুষের দাঁতে গেঁথে আছে রক্তাক্ত মানুষ শিশুর হাতে বেলুনের মতো মানুষের আয়ু যুদ্ধ মাড়ি ও মড়ক কেবলি বৈষম্যবাদিতা। এসব দেখেছি বহুকাল আজ বড়ো দুঃসময় আজ বড়ো অন্ধকার। হাতের মধ্যে সময়গুলো চিপসে যাচ্ছে বারবার।
নীলু, ফিরে না এলে তোর বৌদিকে বলিস: বুকের মধ্যে আগুন নিয়ে জন্ম নেয় যে পুরুষ তার কোনো ঘর নেই সংসার-শিকড় তাকে জড়িয়ে রাখতে পারে না কিছুতেই। জন্মপোড়া তোর এই বন্ধুটাকে ক্ষমা না করে একটা জীবন কাটিয়ে যেতে যেতে সে যেন সহসা বুঝে ওঠে– কোনো কোনো নদী আজন্ম অচেনা থেকে যায় বান না ডাকলেও বয়ে চলে স্রোতের উল্টোদিকে; আমি সেই নদীর মতন চিরদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি নিজেরই বিরুদ্ধে নিজে আমি আমার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নই। জানি, সেও নয় অন্য কারো মতো তবু আমি চাই পৌরাণিক প্রথা সে অন্তত একবার ভেঙে দিক যেন সিঁথিতে লেপ্টে থাকে তার আজীবন রক্তাক্ত সিঁদুর। কপলে আমি না হয় সিঁদুর হয়েই থেকে যাবো দৃশ্যচ্যুত সন্তের মতো।
মান্তু আর বিণিকে বলিস : বাবা বলেছেন তোমরা যেন অনেক বড়ো হও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেড়ে ওঠা নয় বড়ো হওয়া মানে বুঝতে শেখা মানুষজন্মের মানে– মানে এই নষ্ট ভূভাগ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেয়া যেন একেকটি প্রাণ হয় বৃক্ষের মতো সবুজ আর গোলাপের মতো লাল।
আমার এই পুরুষজন্মের শপথ নিয়ে বলি: ফিরে এলে বুঝে নিস সুরঞ্জন আসলে জন্মাতেই পারে নি, না এলে বুঝবি এক জনমে অজস্র জন্ম আমার, মৃত্যুও আমাকে ভয় পায়। দেখিস সূর্যপোড়া এই পৃথিবীটা একদিন ফিরে আসবে আমাদের কাছেই পাতার মর্মরে আর পাখির কুজনে বেজে উঠবে আমাদেরই গান একদিন খুব অভিমানে পালিয়ে যাবে একচক্ষু ঈশ্বরের মিথ্যে অভিধান তাই এখনি সময় রুখে দাঁড়াবার মাথা তুলে উঠে দাঁড়াবার এখনি সময় হ্যাঁ নীলু এখনি এই তারাভরা অন্ধকার আকাশের নিচে সকলে একসঙ্গে এমনকি একা একা একলা হবার পরেও। আমি জানি শেষ পর্যন্ত মানুষকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গের কাছে নয়, ফিরে আসতে হবে মানুষেরই কাছে।
সেই যে দেখা হলো তারপর সুরঞ্জনকে দেখিনি কোথাও। যে গুরুদায়িত্ব সুরঞ্জন আমায় অর্পণ করেছিল তা পালন করতে গিয়ে আমি হাজির হয়েছিলুম রূপশ্রী যেখানে বুকঝিম মধ্যদুপুরের মতন একটি বাড়ি, যে বাড়ির নাম ‘মিছিল’– সুরঞ্জন রেখেছিল। গিয়ে শুনি বৌদিরা এখন অই বাড়িতে নেই– সুরঞ্জনের দাদা ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে। বৌদি বিণি আর মান্তুর কাছে পৌঁছে দেবার সেই যে কথা– আমার রাখা হলো না আর।
জানি না আজ এই সুদীর্ঘ বছর পর এখনো বৌদির সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে থাকে কিনা রক্তাক্ত হয়ে। জানি না মান্তু আর বিণি ওরা আজ হয়েছে কতটা বড়ো। শুধু জানি মানুষেরা এখনো হয় নি বৃক্ষের মতো সবুজ গোলাপের মতো লাল...। চতুর্দিকে শুধু ভাঙনের শব্দ নিঃশব্দ অন্ধকার কারা যেন ধপ করে জ্বলে উঠতে উঠতে নিভে যায় কেউ অপেক্ষা ক’রে নেই ফিরে গেছে যে যার নিজস্ব দেবতার কাছে যে যার আত্মরমণের কাছে। আমার বন্ধু সুরঞ্জন ফেরে নি। সুরঞ্জন হয়ে জন্ম নিলে কেউ ফেরে না কোনোদিন।
প্রলেতারিয়েত
চিমনি ওড়ানো ধোঁয়া
এক টুকরো বিরতি
আর বিরতিহীন সাইরেন
বাজিয়ে বেড়ায়
এ সকল জীবনবিরোধী ঈশ্বর
ঈশ্বরের বিরুদ্ধে জিহাদ
তিন প্রস্থ লংমার্চ
যদিও প্রত্যাদিষ্ট আমি নই
আমি প্রলেতারিয়েত
যন্ত্রণার নাভিমূলে
একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু’পায়া মানুষ
নকশালবাড়ি কবিতা
আঙুল থেকে কলম কেড়ে নিয়ে
ওরা আমার কব্জিটা
হাত থেকে আলাদা করে দিল
দিলেও ওদের কোনো লাভ হলো না
আমি কবিতায় যা লিখবার
লিখে ফেলেছিলাম।
এবার পূর্ব-আকাশে যে লাল সূর্য
উদিত হবে
সেই সূর্যটা কিন্তু আমাদের
হুলিয়া
চলতি পথে কোনো ছায়া দেখলেই
ওরা সন্দিগ্ধ তাকিয়ে থাকে
লক্ষ্য করে দেখে নেয়
ওটা আমার ছায়া কিনা
ওরা আমার ছায়ার বিরুদ্ধেও
জারি করেছিল– হুলিয়া
বিপ্লব
নালি বেয়ে
জাইগোট ভেঙে
ন্যাপকিন ছিঁড়েখুড়ে
সালোয়ার রক্তাক্ত ক’রে দিয়ে
আমি বের হয়ে আসি
জেলভাঙা দাগী আসামির মতো
আমাকে আটকে রাখা যায় না কিছুতেই
আটকে রেখে দিলে
বন্ধ্যা হয়ে যাবে সমগ্র পৃথিবী তোমার
সশব্দ হেমলক
তুমি চাইছো আমাকে ফেলে দেবে
শেয়াল কুকুর আর হিংস্র বাঘের তাণ্ডবে
আর ওরা আমাকে ছিঁড়ে খুবলে খেয়ে
মেরে ফেলবে নিশ্চিত...
ওসব আসলে প্রয়োজন নেই
শুধু একবার বলো– আমাকে তুমি ভালোবাসো নি
সেটাই আমার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে
জীবনের গান
না কফিহাউজে নয়
নয় ড্রয়িংরুমে
বিপ্লব হবে ময়দানে
মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে
মানুষ হয়ে অমানুষের বিরুদ্ধে
মিছিল হয়ে বুলেটের বিরুদ্ধে
প্রেম হয়ে ঘৃণার বিরুদ্ধে
যেন বাঘ আর হরিণ প্রকাশ্য দিবালোকে
জলপান করে নেয় অভিন্ন জলাশয় থেকে
জীবনের জন্য মৃত্যুর বিকল্প আজ অন্য কিছু নেই