মাহবুব রেজার প্রবন্ধ
আমাদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ
এক.
সাহিত্যবোদ্ধারা উপন্যাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই একটি কথা উচ্চারণ করেন, আর তা হলো, উপন্যাসের জন্ম লেখকের আত্মায়। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, একজন লেখককে উপন্যাস রচনার উপাদান সংগ্রহ করার জন্য চৈতন্যের এমন এক অব্যাখ্যেয় পর্যায়ে পৌঁছে যেতে হয় যেখান থেকে জীবন ও সমকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া নানান বিচিত্র ঘটনাসমূহকে তুলে আনা যায় যা দিয়ে পাঠকের মনোজগতে তোলপাড় তোলা সম্ভব। একজন ঔপন্যাসিক তার নীতি-নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার জায়গায় থেকে সেই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করেন বা করার চেষ্টা করেন।
উপন্যাস নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের কথা বলেছেন তবে এক্ষেত্রে গ্যেটের বক্তব্যের প্রতি সমর্থনের পাল্টা ভারী হয়েছে। গ্যেটে উপন্যাস নিয়ে বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলছেন, “উপন্যাস হলো ‘সাবজেক্টিভ ইপোপি’ (ঝঁঢ়লবপঃরাব বঢ়ড়ঢ়বব) আত্মগত মহাকাব্য। লেখক যেখানে জীবন জগতকে তার নিজস্ব পদ্ধতিতে বিচার-বিবেচনা করার অনুমোদন পান। এখানে প্রশ্ন হলো একটাই, লেখকের একান্ত নিজের কোনো পদ্ধতি আছে কি না; তাহলে বাকিটুকু নিজের থেকেই এসে সাড়া দেবে।”
প্রাক সাতচল্লিশ পর্যায়ে যে দুজন ঔপন্যাসিক আমাদের উপন্যাসে বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের নাম অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। তারা হলেন কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) ও হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯)। কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’ এবং হুমায়ুন কবীরের ‘নদী ও নারী’ মূলত এই দুটি উপন্যাসে ব্যক্তির অন্তর্গত জীবন ও বহির্বাস্তবতাকে সমন্বিত করার এক মুন্সিয়ানার পরিচয় মিলেছে। শৈল্পিক উত্তরাধিকার ও সমকাল লগ্নতার সচিত্র দলিল হয়ে উঠেছে এই দুই উপন্যাস। একথা বলার কোনো অবকাশ রাখে না যে, ‘নদীবক্ষে’ এবং ‘নদী ও নারী’র ক্রম ধারাবাহিকতায় সাতচল্লিশ পরবর্তী উপন্যাসের গতিধারা চালিত হয়েছে। এ সময় রচিত হয়েছে নজবির রহমানের আনোয়ারা (১৯১৪), ‘প্রেমের সমাধি’ (১৯১৯), ‘গরীবের মেয়ে’ (১৯২৩), কোরবান আলীর ‘মনোয়ারা’ (১৯২৫), শেখ ইদরিস আলীর ‘প্রেমের পথে’ (১৯২৬)’ কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’ (১৯৩৩), আবুল ফজলের ‘চৌচির (১৯২৭), ‘প্রদীপ ও পতঙ্গ’ (১৯৪০), ‘সাহসিকা’ (১৯৪৬) উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মগত মহাকাব্য রচনার কাজটি উনিশ শতকের শুরু থেকে আমাদের কথাসাহিত্যিকরা করে এসেছেন। মূলত দেশভাগের পর থেকে আমাদের কথাসাহিত্র বাঁক নিতে শুরু করে তার নিজস্ব ধারায়। শিল্পধারার সঙ্গে সঙ্গে অস্তিত্ব, চেতনায় ও দেশপ্রেমে। বিশেষ করে এ সময়টায় উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শ্রেণি বৈষম্যের কথা, অস্তিত্বের কথা, সংগ্রামের কথা, দাবি-দাওয়া আদায়ের কথা সর্বোপরি দেশপ্রেমের কথা-সবকিছুই উপন্যাসের মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে। ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে কথাসাহিত্যে উপন্যাস তার স্বকীয় ধারায় এগিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শওকত ওসমানের ‘জননী’ (১৯৪৭), আবুল ফজলের ‘জীবন পথের যাত্রী’ (১৯৪৮), ‘রাঙ্গা সকাল’ (১৯৫৭) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ ৯১৯৪৮), আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ (১৯৫৬), আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’ (১৯৫২), আবু রুশদের ‘সামনে নতুন দিন (১৯৫৬), সরদার আহমদের ‘জীবন ক্ষুধা’ (১৯৫৫), কাজী আফসারউদ্দীনের ‘চরভাঙ্গা চ’র (১৯৫১), ইসহাক চাখারীর ‘পরাজয়’ (১৯৫৪), জসীমউদ্দীনের ‘বোবা কাহিনী’ (১৯৬৪), নীলিমা ইব্রাহিমের ‘বিশ শতকের মেয়ে’ (১৯৫৯), দিলারা হাশেমের ‘ঘর মন জানাল’ (১৯৫৪), আহসান হাবীবের ‘অরণ্যে নীলিমা’ (১৯৬১), শওকত আলীর ‘পিঙ্গল আকাশ’ (১৯৬৩) ও প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪), সত্যেন সেনের ‘ভোরের বিহঙ্গী (১৯৫৯), ‘রুদ্ধদার মুক্তপ্রাণ’ (১৯৫৯), ‘পদচিহ্ন’ (১৯৬৮), ‘সাত নম্বর ওয়ার্ড’ (১৯৬৯), জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৯), ‘বরফ গলা নদী’ (১৯৬৯), রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’ (১৯৫৯), সৈয়দ শামসুল হকের ‘এক মহিলার ছবি’ (১৯৫৯), ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৯), ‘অনুপম দিন’ (১৯৬৬), খালেকদাদ চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’ (১৯৬৬), প্রায় একই সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ (১৯৬২) ও ‘সারেং বউ’ (১৯৬৫), চৌধুরী শামসুর রহমানের ‘মস্তান গড়’ (১৯৬২), আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘দেয়াল’, ভাওয়াল গড়েরর উপাখ্যান’ (১৯৬৪), শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ রিজিয়া রহমানের ‘বঙ থেকে বাংলা’ (১৯৭৮), ‘রক্তের অক্ষর’ (১৯৭৮), ‘অলিখিত উপাখ্যান’ (১৯৮০), আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠায় সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি, শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘মুখের দিকে দেখি’, আবুল ইব্রাহিমের মৃত্যু’, বুলবুল চৌধুরীর ‘ইতু বৌদির ঘর’, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’, হরিপদ দত্তের ‘অজগর’সহ বিভিন্ন উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা, সামাজিক সঙ্গতি-অসঙ্গতি পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বাস্তব অথচ নির্মম চিত্র। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে রচিত উপন্যাসে বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সচিত্র ইতিহাস চিত্রায়িত হয়েছে। দেশভাবের পর থেকে মধ্যবিত্ত সমাজের উপরিভাগে যে দ্বান্দ্বিক বিকাশের চেতনা অঙ্কুরিত হয়েছিল তা-ই ঊনসত্তরের আগ পর্যন্ত নানাভাবে সাধারণ মানুষের গণজাগরণ হিসেবে গল্প-উপন্যাসে প্রতিভাত হয়েছিল যার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল একাত্তরের লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশ স্বাধীনের মাধ্যমে।
দুই.
বাঙালির অজেয় বীরত্ব গাঁথায় উদ্ভাসিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মহান স্বাধীনতা তার আদর্শ ও চেতনার দীঘল ছায়া এদেশের সবক্ষেত্রে নানাভাবে পরিবর্তনের ছোঁয়া ফেলতে থাকে। শিল্প-সাহিত্রে এর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে কথাসাহিত্য। আর কথা সাহিত্রেল কথা উল্লেখ করতে গেলে সর্বাগ্রে যে মাধ্যমটি চলে আসে তাহলে উপন্যাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে সৃষ্ট স্বাধীন বাংরাদেশে উপন্যাস যেন নবযৌবন, নবধারায় সূচিত হতে চলল একে পর এক।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় আমাদের কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাসকে দিল এক ভিন্নমাত্রা। বিষয় বৈচিত্রে সমৃদ্ধ আমাদের উপন্যাসের আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধ তার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং ক্রমে ক্রমে তা সুদূরপ্রসারী হয়ে দিগন্তকে স্পর্শ করার কৃতিত্বও দেখিয়েছে।। এ প্রসঙ্গে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর বেদনাবহ স্মৃতি ও তার অন্তর্গত জ্বালাযন্ত্রণার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে সৃজনশীল রচনা করাও স্মৃতি ও তার অন্তর্গত জ্বালাযন্ত্রণার দর্ঘি অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে আন্য কোনো বিষয় নিয়ে সৃজনকশীল রচনা করাও তখন সাহিত্যকদের জন্যও একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠল অনিবার্য ও অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে রচিত উপন্যাসে তাই আমরা দেখতে পাই মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের চিত্র। আখ্যানভাগ। লড়াই সংগ্রাম। সমাজ বদলে যাওয়ার গল্প। মুক্তিযুদ্ধের পর রচিত উপন্যাসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমরা শুধু গণহত্যা, নিমর্ম হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ, নিরস্ত্র, মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, অবরুদ্ধ মানুষের যন্ত্রণাগগ্ধ যাপিত জীবন, বন্দি শিবিরে অবর্ণনীয় নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ ও হত্যার পঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাই পাই না, সেই সঙ্গে আমরা পাই মানুষের নতুনভাবে জেগে ওঠার বীজমন্ত্র, নব জীবনের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক ও সমাতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্রের সার্থক প্রতিফলন।
সাহিত্য সমালোচকরা যখন বলে থাকেন, লেখকরা তাদের লেখায় ভূত-ভবিষ্যতের আগাম বার্তা দিতে পারেন, তখন তা অবিশ্বাস করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কথাটা যে সত্য তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনতার বেশ কবছর আগে থেকেই ঔপন্যাসিকরা দেশের সমাজ পরিবর্তনের আগাম বার্তা সেই সঙ্গে রাজনীতির সার্বিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে তাদের উপন্যাসে দেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কালকে অনুভব করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৭ সালের পর থেকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত রচিত বেশ কয়েকটি উপন্যাসে সার্বিকভাবে বাঙালির জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি নানাভাবে উঠে এসেছে যা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিশষভাবে উল্লেখ করা যায়, আবুল ফজলের ‘রাঙা প্রভাত’ শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাস’, ‘রাজা উপাখ্যান’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক, আবু রুশদের ‘ডোবা হল দীঘি, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘আনোয়ার পাশার ‘নীড় সন্ধানী’, ইন্দুর সাহার ‘কিষাণ বউ’, সত্যেন সেনের ‘উত্তরণ’, ‘জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ ও জহিরুল ইসলামের ‘অগ্নিসাক্ষী’ উপন্যাসে স্বাধীনতর সংগ্রামের আগাম ইঙ্গিত উঠে এসেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার রূপায়নে ঔপন্যাসিকরা সন্ধান করেছেন এক নতুন শিল্পরীতির, যে শিল্পরীতিতে বাঙ্গময় হয়ে উঠেছে তাদের রচনা। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নানা যৌক্তিক কারণে উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বদলেছে পটভূমি বদলেছে। চরিত্রের চিত্রায়ণের দৃশ্যপটও বদলেছে। অর্থাৎ সার্বিক অর্থে উপন্যাসের শরীরে পরিবর্তনের বিপ্লব ঘটেছে। একই সঙ্গে উপন্যাসের ও বিষয়ের যেমন বিস্তার ঘটেছে তেমনি তার গদ্যরীতি থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এক স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী চার দশকে দেশের সমাজ-রাজনীতি-সাংস্কৃতিক চেতনা ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নানারকম রূপ-রূপান্তর ঘটেছে তা আমাদের উপন্যাসে দালিলিক প্রমাণের মতো উঠে এসেছে। মধ্যবিত্ত জীবন, সমাজের লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষের দুঃখ-কষ্ট-আখ্যানভাগ, গ্রাম জীবন, গ্রাম অর্থনীতি, নগরজীবন সর্বোপরি স্বাধীনতার কয়েক বছরের মাথায় দ্রুত বদলে যাওয়া রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মনোজাগতিক পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় বিশ্লেষণ উপন্যাসে যোগ করেছে শক্তিশালী মাত্রা। এ ক্ষেত্রে সে সময় রচিত উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের নীতি-আদর্শ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, রুচি, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাস বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এ সময় অর্থাৎ ব্যক্তি-স্বাধীনতা, রুচি, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাস বিশেষভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। এ সময় অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে উপন্যাস পথ চলেছে সমাজ, রাজনীতি ও তার চারপাশে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকা নানা বিষয়কে অনুষঙ্গ করে। এর ফলে উপন্যাসের মধ্যে পাঠক তার নিজের আত্মসন্ধান, সত্যানুসন্ধান ও জাতিসত্তা-সন্ধানের প্রেরণা খুঁজে পেয়েছে। লোক পুরাণ, পুরাণ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রূপক-প্রতীকের সমন্বয়ে এ সময়ে উপন্যাসে উঠে এসেছে বারবার।
তিন.
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম লিখিত উপন্যাসের নাম আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। জানা যায় একাত্তরেরর মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাস লিখিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী শিক্ষক আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধ চলাচালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে খুব কাছে থেকে পাক হানাদার বাহিনীর বীভৎস, অত্যাচার-নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এক রকম অবরুদ্ধ থেকে আনোয়ার পাশা ২৫ মার্চের কালরাত্রির নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছিলেন। অবরুদ্ধ থেকে তিনি তার কথা লিখলেন উপন্যাসে। তিনি ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসের এক জায়গায় লিখছেন, ‘নীলক্ষেতের পরিত্যক্ত রেল লাইনের দুপাশে বাস করত হাজার হাজার গরিব মানুষ। এক সময়ে ঝড়ে-বন্যায় গ্রাম বাংলার লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা শহরে এসেছে- তারাই এখানে এসে হয়েছে বস্তিবাসী। সেই গরিব মানুষের বস্তি পুড়িয়ে অশেষ বীরত্ব দেখিয়ে গেছে পাক-ফৌজ।’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন তার শ্রেণি অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন। শাহীন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি এ কথা যেমন সত্য ঠিক একই রকম এই শাহীনই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী শক্তিরূপে নিয়োজিত থেকে নিজের বিবেকের কাছে পরিস্কার থেকেছেন। আত্মজৈবনিক ও উপন্যাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিব কালের প্রামাণ্য দলিল উঠে এসেছে যা এ উপন্যাসকে আলাদাভাবে চিত্রিত করেছে।
‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি শওকত ওসমান মুক্তিযুদ্ধকালে লিখেছেন। একাত্তর সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ উপন্যাসে ২৫ মার্চের গণহত্যার বিভীষিকাময় চিত্রও এ উপন্যাসে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কুল শিক্ষক গাজী রহমান রাজধানী থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’কে কাহিনী নির্ভর উপন্যাস বলা যাবে না, এটি চিত্রধর্মী উপন্যাস। শওকত ওসমানের আরেক উপন্যাস ‘নেকড়ে ও অরণ্যে’ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে বাঙালি নারীদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে সে উপন্যাসে তারই চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’ ‘জলাংগী’ উপন্যাসেও মুক্তিযুদ্ধ সরাসরিভাবে এসেছে।
‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে আবর্তিত করে মধ্যবিত্ত বাঙালির দ্বিধা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের উন্মোচন করেছেন রশীদ করীম। দেশভাগের আগ থেকে একাত্তরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৭০- এর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সত্তরের নির্বাচন, গণপরিষদের অধিবেশন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যুদ্ধের কবলে দেশ ও জাতি বিষয়গুলো মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের মননে কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল তারই ধারাবাহিক ছবির নির্যাস এ উপন্যাস। আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসে লেখক বলেছেন, ‘পঁচিশ তারিখের রাতে ট্রাকভর্তি মরা মানুষ দেখা গেছে। একটা দুটো নয়, ডজন ট্রাক। একটা- দুটা মরা মানুষ নয়, শত শত। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। সবাই আবার মরেওনি। পাশে, নিচে, মরা লাশ; সেই অনড় স্তূপের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ একটা হাত একবার নড়ে ওঠে।’
‘নীল দংশন’, নিষিদ্ধ লোবান’ এবং ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। একাত্তরের যুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশ যে বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল তার নিখুঁত বর্ণনা চিত্র ঘটনার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের কথা ‘নীল দংশন’এ- উঠে এসেছে। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসে জলেশ্বরীর চেতনায় ও প্রতীকে দেশকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন লেখক। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ উপন্যাসে লেখক মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ঘটনাবলির বাঙ্ময় উপস্থাপন করে পাঠককে চমকে দিয়েছেন।
‘যাত্রা’ উপন্যাসে শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের সময়কালকে নির্ণয় করে রচিত। উপন্যাসটি ১৯৭২ সালে রচিত হলেও ১৯৭৬ সালে এর প্রকাশ। মূলত ‘যাত্রা’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের বিভিন্ন ঘটনা-অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। শওকত আলীর প্রাঞ্জল বর্ণনা ও ঘটনার ভেতর প্রবেশ করে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন, ‘ওদিকে উত্তরে শহরের আকাশে এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ডাইনে থেকে বাঁয়ে, গোনা যায় আজ-একটা, দুটো তিনটে-চারটে, পাঁচটা-ঐ যে আরেকটা, ওদিকে বাঁয়ে আবার আরেকটা আরম্ভ হচ্ছে। তবু গোনা যায়। গতকাল যেত না।’
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অধ্যাপক রায়হান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। এক সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি স্বধীনতার প্রশ্নে আশাবাদী কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নে দোদুল্যমান ও সংশয়গ্রস্ত। রায়হান তার অবস্থানগত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি তবে ঔপন্যাসিকের আত্মজীবনীর প্রতিচ্ছায়া রয়েছে।
রিজিয়া রহমান এপিক ফর্মে লেখা ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে আড়াই হাজার বছর পূর্বকাল থেকে একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকাল পর্যন্ত সময়সীমা ও এর ঘটনাপ্রবাহকে বিস্তৃত কলেবরে তুলে এনেছেন।
স্বাধীনতার পর এপিক ফরমে আবু জাফর শামসুদ্দীন বর্ণনাত্মক রীতিতে তার ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ উপন্যাস ইতিহাসের বিশাল পটভূমিকে মহাকাব্যিক আয়তনে রূপ দিয়েছেন। বিচিত্র জীবন ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে এতে। এছাড়া তার ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাধারণ দলিল হিসেবে পরিগণিত। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আব্দুল্লাহর দৃষ্টিকোণ এক ভিন্নমাত্রার শিল্পবলয় তৈরি করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাক বাহিনীর আক্রান্ত হয়েছে- উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয়েছে। আজীবন পাকিস্তানের বংশবদ আব্দুল্লাহর চৈতন্যে মুক্তিযুদ্ধ এক নতুন দ্বারা উন্মোচন করে। আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধ আব্দুল্লাহর আদর্ম, বিশ্বাস, দেশপ্রেমকে এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। বিপ্রতীপতা উদঘাটন পদ্ধতিতে আবু জাফর শামসুদ্দীন ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ উপন্যাসে আব্দুল্লাহর ভেতর দিয়ে এক নতুন জগতকে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।
‘খাচায়‘ উপন্যাসে রশীদ হায়দার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবরুদ্ধ নগরজীবনের চিত্র বিশাল ক্যানভাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। ঢাকা শহরের তিনতলার ফ্ল্যাটে অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের বিপন্নতা, অসহায়তা, নিরাশ ও সংশয়ের কাহিনী ‘খাঁচায়’ উঠে এসেছে। কলেবরে ক্ষুদ্র হলেও ‘খাঁচায়’উপন্যাসটিতে বন্দ্বীত্ব দশা থেকে মানুষের মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষাও বড় হয়ে এসেছে। ‘অন্ধ কথামালা’ রশীদ হায়দারের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর উপন্যাস। এ উপন্যাসে লেখক বাংলার জনপদ, তার অন্তর্গত ব্যক্তি ও সমষ্টি, ব্যক্তির প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি, সঙ্কট ও যন্ত্রণার স্বরূপ উন্মোচিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসটিতে এর নায়ক খোকা একজন সমাজ-সত্তা-বিচ্ছিন্ন একজন ব্যক্তি। লেখক এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে অংশ নিরাপদ থাকার আকাঙ্ক্ষায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন তাদের ছবি এঁকেছেন। এছাড়া এ উপন্যাসে সফলভাবে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদ, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতির ব্যবহার বড় করে দেখানো হয়েছে।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সেলিনা হোসেনের অসাধারণ রচনা। এ উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সুনিপুণ ছবি তুলে এনেছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল হলো এ উপন্যাসের সময়কাল। বিস্তৃত পটভূমিতে লেখা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনযাত্রা, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মানুষের পরিণতি ও আকাঙ্ক্ষা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নারী নির্যাতন, রাজাকার বাহিনীর অপতৎপরতা সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু বুড়ি। এই বুড়ি চরিত্রটির ভেতর বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাদ নানামুখী ক্রিয়া তৈরি করে। হলদী গায়ের প্রতীকী অবস্থানও উপন্যাসে স্বার্থকভাবে উঠে এসেছে। এই উপন্যাসের সবক’টি চরিত্রের উৎস গ্রাম হলেও কাহিনী বর্ণনায় ঔপন্যাসিকের গভীর জীবনোলপব্ধির প্রমাণ মেলে। মূলত বুড়ি চরিত্রের মধ্য দিয়ে অবরুদ্ধ দেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরা হয়েছে।
‘ওঙ্কার’ মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আহমদ ছফার এক অনবদ্য রচনা। এ উপন্যাসে এক বোবা মেয়ে ঘটনা পরম্পরায় আকস্মিক সবাক হয়ে ওঠা চমকে দেয় পাঠককে। বোবা মেয়ের সবাক হয়ে ওঠার এই ঘটনা ষাটের দশকের বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের ইঙ্গিতকে সুস্পষ্ট করে। ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসে সামরিক শাসন পীড়িত, অবরুদ্ধ জাতীয় অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে সুবিধাবাদী, প্রতারক ষড়যন্ত্রপরায়ণ ও পাকিস্তানি আদর্শের ধারক-বাহক আবু নসর মোক্তারের বোবা মেয়ে। আহমদ ছফা প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে ‘ওঙ্কার’ এ তুলে ধরেছেন দেশ-বিভাগের কালের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন।
‘ওঙ্কার’ উপন্যাসের একেবারে শেষের দিকে দেখা যায়, ‘মিছিলটি একেবারে আমাদের বাড়ির সামনে এসে পড়েছে। গোটা মিছিলটা যেনো বাংলাদেশের আগ্নেয় আত্মার জ্বালামুখ। সমস্ত বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় এক প্রসব বেদনা ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বুকফাটা চিৎকারে ধ্বনিত হচ্ছে নবজন্মের আকুতি... চারপাশের সবকিছু প্রবল প্রাণাবেশে থরথর কাঁপছে। বাংলাদেশের আকাশ কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে, নদী, সমুদ্র, পর্বত কাঁপছে, নরনারীর হৃদয় কাঁপছে। আচানক বোবা বৌ জানলা সমান লাফিয়ে ‘বাঙলা’ শব্দটি অত্যন্ত পরিস্কারভাবে উচ্চারণ করল। তার মুখ দিয়ে গলগল রক্ত বেরিয়ে আসে।’
হাসনাত আবদুল হাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ‘তিনি’। তার এ উপন্যাসটিকে শিল্প স্বভাবের বিবেচনায় উল্লেখ করা যেতে পারে প্রতীকী বৈশিষ্ট্যম-িত উপন্যাসে। উপন্যাসের চরিত্র নওয়াজেশ আলীর সঙ্গে লেখক সর্বগ্রাসী প্রাণী তিমির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীর সময়ের আক্রমণ প্রতি আক্রমণের চিত্র আছে। ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে নাগরিক জীবনের অদ্ভুত বর্ণনা রয়েছে- রয়েছে পাকবাহিনীর বর্বরতার আখ্যানভাগও। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ এ উপন্যাসে বিস্তারিতভাবে এসেছে।
শামসুর রহমানের ‘অদ্ভত আঁধার এক’ উপন্যাসে যুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের মানস পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কবি ও সাংবাদিক নাদিম ইউসুফ। ২৫ মার্চের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে মুক্তিযুদ্ধে তার দ্বন্দ্বময় টানাপড়েন, ব্যারিকেড, মর্টার, চিৎচার, আগুন, কারফিউ, রেডিও, কুকুরের ডাক, জলপাই রঙের জিপ-নানা বিষয় তুমুল কাজ করতে থাকে। মূলত আত্মজৈবনিক ঢঙে শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধে নিজের কথা বলার চেষ্টা করেছেন।
আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, বাংলার সার্বিক চিত্র পাওয়া যায়। উপন্যাসের বিষয় পাক বাহিনীর আক্রমণের ভীতসন্ত্রন্ত্র, গ্রামবাসীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানকে কেন্দ্র করে।
হুমায়ূন আহমেদ সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক ভিন্ন মাত্রার ছবি চিত্রায়িত করেছেন। লেখকের পিতা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং লেখক নিজেও মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ফলে যুদ্ধটাকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অনুভব করেছেন। লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এই লেখক, পাঠককে নিয়ে গেছেন এক অচিন লোকে যেখানে আনন্দ-দুঃখ ভালবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ‘শ্যামল ছায়া’, অনিল বাগচীর একদিন, সৌরভব, আগুনের পরশমণি, ১৯৭১ এবং জোছনা ও জননীর গল্পসহ অনান্য উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ এসছে। পরিকল্পিতভাবে প্রত্যক্ষভাবে।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে দেশ যখন উল্টো পথে চলছিল তখন মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ সংক্রা চিন্তার বিষয়গুলো মুখ থুবড়ে পড়ছিল। সে সময় ‘রাজাকার’ ‘পাকহানাদার বাহিনী’ বলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। তখন হুমায়ুন আহমেদের কল্যাণে দেশের মানুষ ‘তুই রাজাকার’ বলার সাহস পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তার একটি জনপ্রিয় নাটকে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ রাজাকারদের প্রতি তার এবং দেশবাসীর পুঞ্জীভূত ঘৃণা জানিয়ে দিয়ে তিনি সবার শ্রদ্ধাভাজনে পরিণত হন।
হুমায়ুন আহমেদ ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনায় পূর্বের সব রীতিনীতি এখানে মানেননি। যেভাবে লিখে আনন্দ পেয়েছেন সেভাবেই লিখেছেন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিনটি কালকে কখন যে লেখক একাকার করে দিয়েছেন উপন্যাসের ভেতর, কখন পাঠককে যে নিয়ে গেছেন স্বপ্নে, কখন ফিরিয়ে এনেছেন বাস্তবে টেরই পাওয়া যায় না। ঘটনার ধারাবাহিকতা, ইতিহাসের তথ্যসূত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্রমবিবরণ সব মিলিয়ে ‘ জোছনা ও জননীর গল্প’’ শেষ পর্যন্ত কেবল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসই থাকেনি, হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। উপন্যাসটি পাঠ করতে করতে পাঠক একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাসকে খুঁজে পাবেন। আর? মুক্তিযুদ্ধকালীর পাকবাহিনীর কর্মকাণ্ডে পাঠক ক্রোধে-ঘৃণায় যেমন ফুঁসে উঠবে তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর মায়া-মমতা, ভালবাসায় চোখের জলে দুচোখের পাতাকে ভেজাবেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উপন্যাসের শেষভাবে লেখক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে অপার ভালবাসা দেখিয়েছেন তা ইতিপূর্বে অন্য কোনো রচনায় উঠে আসেনি।
হুমায়ুন আহমেদ তার অমর সৃষ্টি ‘ জোছনা ও জননীর গল্প’ শেষ করেছেন এভাবে, ‘তারও অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি গোঁফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছেন, তাকে কী আমি চিনি? দীর্ঘকার এই যুবক দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, মা দেখ, কে এসেছে! মাগো দেখ কে এসেছে!
মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে- আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছো কেনো? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে।
নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরেছিল না। তার হাত এখন প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত। বলেই আমি এ রকম একটি সমাপ্তি তৈরি করেছি।অ বাস্তবের সমাপ্তি এ রকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায় এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে! আহারে!’
ইমদাদুল হক মিলনের ‘ঘেরাও’, কালো ঘোড়া, বালকের অভিমান, মহাযুদ্ধ, নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্য। কালো ঘোড়া উপন্যাস একটি গ্রামকে ফিরে। ক্র্যাক, মুক্তিযুদ্ধ, শান্তি কমিটির মানুষজন যুদ্ধকে সামনে রেখে তাদের ফায়দা লুটে নিচ্ছে- এর মধ্যেই সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ত, বিপন্নতা এবং এরই মধ্যে মানুষের ভেতর জমে থাকা প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের চরম প্রকাশ কীভাবে হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ ‘কালো ঘোড়া’,।
মঈনুল আহসান সাবেরের পাথর সময়, পরাজয়, কেউ জানে না, সতের বছর পর মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। উল্লিখিত উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা উত্তর বিশেষ করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ১৭ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাজনৈতিক সঙ্কটের স্বরূপ এবং তার পরিণতি বিধৃত করেছেন। তার উপন্যাস চতুষ্টয়ের স্বরূপ ও পরিণতিতে দেখা যায় রাজনীতিতে, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে কীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটছে।
মঞ্জু সরকার তার ‘নগ্ন আগন্তুক’, ‘তমস ও প্রতিমা’ উপাখ্যান উপন্যাসের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আস্ফালন ও পুনরুত্থানের চিত্র বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে তার উপন্যাসকে রাজনৈতিক উপন্যাস বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাহিত্য সমালোচকরা মঞ্জু সরকারের উপন্যাসের এই চিহ্নিত করার জবাব দেন এভাবে, একাত্তর আর মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আমাদের রাজনীতি অর্থহীন।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এ কথা যেমন সত্য তেমনি একথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিল্পসাহিত্যকেও দ্ব্যর্থহীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বল্প পরিসরে এখানে তার সব হয়তো তুলে ধরা গেল না তবে আমাদের ঔপন্যাসিকরা তাদের চিন্তা চেতনায় লেখায় মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ
নিউজবাংলাদেশ.কম/টিএবি
নিউজবাংলাদেশ.কম